Monday, January 6, 2025
Monday, January 6, 2025

ইতিহাসের সাক্ষী

সৌন্দর্য হারাচ্ছে কারুকার্য খচিত কোদলা মঠ

আলিফা ইয়াসমিন | প্রকাশ: ১৬ মে ২০২২

প্রায় ১৩ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন অযোধ্যা মঠ। ছবি: আলিফা ইয়াসমিন।

বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর ভিতর অন্যতম কোদলা মঠ। অযোধ্যা মঠ নামেও পরিচিত দৃষ্টি নন্দিত এই সুপ্রাচীন স্থাপনাটি বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বারুইপাড়া ইউনিয়নের যাত্রাপুর গ্রামে অবস্থিত। অবহেলা আর অযন্ত্রে পুরাকীর্তিটি বর্তমানে হুমকির মুখে। 

মঠের বাইরের দেয়াল পুরোটাই লাল ইটের তৈরি এবং পোড়া মাটির ফলকে আবৃত। বাগেরহাট শহর থেকে খুব কাছেই এই মঠটি। যদিও সাধারণের কাছে খুব বেশি পরিচিতি নেই এই মঠের। মঠটির বিসদ বিবরণ পাওয়া যায় ষাট গম্বুজ মসজিদ সংলগ্ন জাদুঘরে এবং সেখান থেকে কাছেই মঠটির অবস্থান। 

বাগেরহাট শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে এর অবস্থান। বাংলাদেশে জাতীয় তথ্য বাতায়ন এর সূত্র মতে, পুরাতন বাগেরহাট-রূপসা সড়কে অবস্থিত যাত্রাপুর বাজার হতে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে প্রাচীন ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে এই অযোধ্যা মঠ অবস্থিত।

মঠটি অযোধ্যা গ্রামে অবস্থিত বলে অযোধ্যা মঠ নামে বেশি পরিচিত। তবে কোদলা মঠ নামেও এর পরিচিতি কম নয়। অযোধ্যার পাশেই অবস্থিত গ্রামের নাম কোদলা। 

বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত অন্যতম সংরক্ষিত একটি পুরাকীর্তি হয়েও অনেকটাই অবহেলা, অযত্নে পড়ে আছে মহা মূল্যবান প্রাচীন এই স্থাপনাটি। মঠের চারিদিকে দেয়ালের গায়ে পরগাছার বংশবৃদ্ধি চোখে পড়ার মত। দেয়ালের উপরিভাগে বেড়ে ওঠা এই পরগাছায় মঠের বাইরের সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশে জাতীয় তথ্য বাতায়ন এর সূত্র মতে, ভূমি থেকে উচ্চতা প্রায় ১৮.২৯ মিটার। ভেতরে বর্গাকার প্রতিটি দেয়ালের দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৬১ মিটার। দেয়ালগুলো পুরুত্ব প্রায় ৩.১৭ মিটার। মঠে প্রবেশদ্বার রয়েছে তিনটি। যার থেকে ধারণা করা হয়, দক্ষিণদ্বার ছিল মূল প্রবেশপথ। অন্য দুটি প্রবেশ পথ রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে। সবচেয়ে নজরকাড়া বিষয়টি হল, এই মঠটি বর্গাকৃতির ভিতের উপর নির্মিত। 

বিভিন্ন কারুকার্যে অলঙ্কৃত মঠের দেয়াল। ছবি: আলিফা ইয়াসমিন।

প্রবেশপথগুলোর উপরে পোড়া মাটিতে খোদাই করা কারুকার্যগুলোর মধ্যে ফুল, লতা-পাতা ইত্যাদি নকশা এখনো দৃশ্যমান। বিশেষত, দক্ষিণ দিকের প্রবেশ পথের উপরে প্রাচীন বাংলায় মঠটি সম্পর্কে খোদাই করা রয়েছে। ভেতরের দিকে প্রায় ১৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা গম্বুজ উপরের দিকে উঠে গেছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে স্থাপত্যিক বৈশিষ্টানুসারে অনুমান করা হয় যে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। মঠটিতে দক্ষিণ কার্ণিশের উপরে খোদাই করা পোড়া মাটির ফলক থেকে এর ইতিহাস বিষয়ে কিছু পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেই লিপি অনুযায়ী সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে দেবতার অনুগ্রহ লাভের আশায় কোনো এক ব্রাহ্মণ মঠটি নির্মাণ করেছিলেন।

বাংলাদেশে জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই ক্ষয়প্রাপ্ত পংক্তিমালার যতদূর পাঠোদ্ধার করা যায় তা থেকে অনুমান করা হয় যে, তারকের (ব্রক্ষ্ম) প্রাসাদ লাভের উদ্দেশ্যে এই মঠটি খুব সম্ভবত একজন ব্রাক্ষ্মণ (শর্মনা) কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া অযোধ্যা মঠ সংলগ্ন প্রাঙ্গণের সামনে অবস্থিত ফলক থেকে জানা যায় রাজা প্রতাপাদিত্য তার সভাসদের স্মতিস্তম্ভ হিসাবে মঠটি নির্মাণ করা হয়। 

এর পাশাপাশি লোকমুখে শোনা যায় যে, কারো চিতা পোড়ানো ছাইয়ের উপর এ মঠটি নির্মিত হয়েছিল। এই প্রাচীন প্রত্নতত্ব সম্পর্কে স্থানীয়রা ছাড়া খুব কম মানুষ জানতেন এবং পর্যটকদের ভিড়ও কম হত। 

বর্তমানে পাখির কলকাকলিতে পরিপূর্ণ এই মঠটিতে আগের থেকে পর্যটকদের আশা যাওয়া অনেকাংশে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে জরাজীর্ণ এই মঠটির সংরক্ষণে আরো বেশি জনসচেতনতা প্রয়োজন বলে তারা মনে করছেন। 

এই বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বেলাল হোসেন বলেন, ‘এমন সব প্রাচীন স্থাপত্য যত্নের অভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, যার রক্ষণাবেক্ষণের দিকে সরকারের দৃষ্টিপাত একান্ত জরুরি। এমন নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেলে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে না যে এমন কিছু নিদর্শন বাংলাদেশে ছিল। তারা ইতিহাস থেকে শেখার পাশাপাশি পর্যবেক্ষণের সুযোগ ও পাবেন।’

আরও পড়ুন