খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
সীমাবদ্ধতার মাঝেও মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে আইকিউএসি
মীর হাসিব | প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২২
বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০০৯ সালে সরকার ‘হাইয়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহেন্সমেন্ট প্রজেক্ট (হেকেপ)’ হাতে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা মোতাবেক হেকেপের প্রকল্পের অধীনে ২০১৪ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুবি) ‘ইন্সটিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি)’ গঠন করা হয়।
হেকেপ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবার পর ২০১৮ সাল থেকে ইউজিসির সাথে সম্পাদিত পূর্বোক্ত চুক্তি ও নির্দেশনা মোতাবেক খুবিতে আইকিউএসি তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে অবকাঠামোগত সমস্যা, জনবল সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও আইকিউএসি খুবির মান উন্নয়নে সর্বাত্মক কাজ করে যাচ্ছে।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
খুবির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক উৎকর্ষ অর্জনের লক্ষ্যে সর্বোত্তম অনুশীলনের মাধ্যমে মান নিশ্চিত করাই আইকিউএসি’র ভিশন। এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গুণমান নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক শিক্ষার ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা ও সর্বোত্তম ব্যবস্থা অনুশীলনের মাধ্যমে বিশ্বায়িত পরিবেশে উচ্চশিক্ষার অংশিজনদের নির্ভরতা অর্জন করাই আইকিউএসির মিশন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় একই ধরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৫ সালে খুবিতে ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স ইন টিচিং এন্ড লার্নিং (সিইটিএল)’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউজিসি’র নির্দেশনা মোতাবেক ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আইকিউএসি’র সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে সিইটিএল সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়।
জনবল
আইকিউএসি’র সাবেক অতিরিক্ত পরিচালক ও অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হায়দার বর্তমানে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। অতিরিক্ত পরিচালকের দায়িত্বে আছেন এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. মতিউল ইসলাম, সয়েল ওয়াটার এন্ড এনভারোনমেন্ট ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. জগদীশ চন্দ্র জোয়ারদার এবং নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান।
এছাড়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে আছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোঃ নুরুল ইসলাম সিদ্দিক লাবলূ, সেকশন অফিসার মোঃ মোস্তফা আল মামুন প্রবাল, চুক্তিভিক্তিক হিসাবরক্ষক মোঃ শাহরিয়ার শিকদার, অফিস সহায়ক রনজিৎ কুমার মন্ডল, মাস্টাররোলে কর্মচারি মোঃ ফকির সোহরাব হোসেন।
কার্যক্রম
খুবির আইকিউএসি মুলত দুইটি ভাগে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে ‘এক্সিলেন্স ইন টিচিং এন্ড লার্নিং (ইটিএল)’ এবং ‘সামগ্রিক কোয়ালিটি এসুরেন্স (কিউএ)’। চলতি বছর আইকিউএসি এসংক্রান্ত বেশকিছু কর্মকান্ড সম্পন্ন করেছে।
এসকল কর্মকান্ডের মধ্যে শিক্ষকদের জন্য আউটকাম বেসড কারিকুলা টেম্পলেট তৈরি, গবেষণায় অনুদানপ্রাপ্ত প্রকল্পের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সাম্প্রতিকালে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের টিচিং-লার্নিং দক্ষতার বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়।
এদিকে প্রথম বর্ষে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ দিনব্যাপী একাডেমিক কাউন্সিলিং এন্ড মোটিভেশন শীর্ষক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কর্মশালাটির মাধ্যমে নবাগত শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় সফলতা অর্জনের বিভিন্ন দিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়মকানুন, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতিসহ নানা বিষয়ে সেখানে আলোকপাত করা হয়।
এছাড়া জুনিয়র কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়। খুবিকে পেপারলেস বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে কর্মকর্তাদের জন্য ই-নথি বিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। আইকিউএসি দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এখন পর্যন্ত খুবিতে সর্বাধিক সংখ্যক প্রশিক্ষণার্থী ই-নথি বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে আইকিউএসির অতিরিক্ত পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মতিউল ইসলাম জানান, “নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্য আমরা বছরব্যাপী পরিকল্পনা হাতে নিয়ে এগোচ্ছি। এর মধ্যে ওরিয়েন্টেশন, আনন্দদায়ক পাঠদানের কার্যকর পদ্ধতি, নীতি-নৈতিকতা, গবেষণা পদ্ধতি ও অর্থায়ন, জার্নালে মৌলিক গবেষণাপত্র প্রকাশ, কর্মকর্তাদের জন্য ই-নথি ও অফিস ব্যবস্থাপনার মতো নানা প্রশিক্ষণ রয়েছে।”
তিনি আরো জানান, “এসকল প্রশিক্ষণের জন্য আমরা এবছর প্রায় ২৭ লক্ষ ৬ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। যদিও এটা পর্যাপ্ত নয়। তবে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন।”
সমস্যা ও সংকট
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পুরাতন প্রশাসনিক) ভবনের দ্বিতীয় তলায় আইকিউএসি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে জায়গার সংকুলান প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল।
সোমবার (১১ এপ্রিল) সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনের মধ্যে যত্রতত্র পুরাতন আসবাবপত্রসহ বাঁশ, কাঠ, রঙ ইত্যাদি নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র পড়ে রয়েছে। দেয়ালে সম্প্রতি রঙ করা হলেও দরজা, জানালা, ভেন্টিলেটর ও ঝুলন্ত তারে পুরনো ভবনের ছাপ স্পষ্ট। মেঝেতে ধুলোবালির আস্তরণ জমা পড়েছে।
আইকিউএসি’র ছোট আকারের এক একটি কক্ষে কর্মকর্তারা কোনো রকমে ফাইলপত্র রেখে গাদাগাদি করে কাজ করছেন। এছাড়া আইকিউএসি দপ্তরের ঠিক পাশেই নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর শৌচাগারের দেখা মেলে। আবার এর ঠিক সামনেই অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় খাবার পানি শোধনের যন্ত্র রাখা হয়েছে। ভবনটি পুরাতন হওয়ায় ও চলমান নির্মাণ কাজের কারণে এধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এছাড়া আইকিউএসি’র কর্মকান্ড বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এ সর্ম্পকৃত অনেক তথ্য-ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে ওয়েবসাইটি নতুন করে হালনাগাদ করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
প্রত্যাশা
আইকিউএসির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ জন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এদের মধ্যে শিক্ষকবৃন্দ ক্লাস-পরীক্ষা ও প্রশাসনিক কাজের বাইরে দীর্ঘ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ আয়োজনের বিষয়টি তুলে ধরেন।
খুবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, “আইকিউএসি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে কাজ করছে। এর মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষায় একটি সুশৃঙ্খল ও পদ্ধতিগত সিস্টেম চালিয়ে নেয়া সম্ভব। তবে এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শিক্ষকদের উপর যে বাড়তি চাপ তৈরি হবে, সেজন্যে শিক্ষকদের প্রণোদনা দেওয়াও প্রয়োজন।”
আইকিউএসি’র অতিরিক্ত পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. মতিউল ইসলাম জানান, “আমাদের এখানে শিক্ষকরা পাঠদানের পাশাপাশি ইন্টেন্সিভ গবেষণা কাজে ব্যস্ত থাকেন। এই ব্যস্ততার মাঝে যখন কোন শিক্ষককে আইকিউএসির কোন পোগ্রামে আনতে চাই তখন তাঁকে পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। আগামী অর্থবছর থেকে বরাদ্দ দ্বিগুণ হবে বলে আশা করছি।”
শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে কর্মশালা আয়োজনের বিষয়ে তিনি জানান, “প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউজিসির তত্ত্বাবধানে একটা সেন্ট্রাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ইন হাউস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। অন ক্যাম্পাস ট্রেনিং ইনস্টিটিউট দিয়ে আসলে কাভার করা সম্ভব না। তাছাড়া কিছু ডিসিপ্লিনে শিক্ষক সংকট রয়েছে। তাই ক্লাস বাদ দিয়ে কর্মশালা আয়োজন করা ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।”
অপরদিকে শিক্ষার্থীরা অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে কর্মশালা সংক্রান্ত আয়োজন বাড়ানোর কথা জানান। এছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়োগের পরপরই বাইরে থেকে প্রশিক্ষক এনে কর্মশালা আয়োজনের কথা জানান।
গণিত ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী আরাফাত ইসলাম বলেন, “অনার্স শিক্ষা জীবনের প্রথম বর্ষে আইকিউএসির শুধুমাত্র ওরিয়েন্টশন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলাম। এরপর শিক্ষার্থীদের জন্য আর কোন অনুষ্ঠান পাইনি। আমাদের জন্য গবেষণা, উচ্চশিক্ষা, বৃত্তি, ক্যারিয়ার গাইড লাইনের মতো বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত।”
এদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরো বৃহৎ পরিসরে ও দ্রুত প্রশিক্ষণ আয়োজনের কথা জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘সম্প্রতি আইকিউএসি কর্মকর্তাদের জন্য ই-নথি বিষয়ক প্রশিক্ষণসহ বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ করেছে। ভবিষ্যতে বাইরে থেকে আরো রিসোর্স পার্সন আনা ও কর্মকর্তা নিয়োগের সাথে সাথে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে প্রশাসনিক কাজের গতি নতুন মাত্রা পাবে।’
তবে এসকল আয়োজনের জন্য আইকিউএসির সক্ষমতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
এবিষয়ে আইকিউএসি’র পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জিয়াউল হায়দার বলেন, “শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে দ্রুত ওরিয়েন্টশন আয়োজন করা ও পরবর্তী সময়েও এই ধরণের অনুষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করতে পারলে আরো ভালো হতো। আইকিউএসি’র ভবিষ্যৎ কর্মসূচিতে এসকল বিষয় অন্তর্ভূক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে আইকিউএসি’র অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও লোকবল বাড়ানো দরকার। নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষক ও হিসাবরক্ষক প্রয়োজন। তবে এত সব সীমাবদ্ধতার মাঝেও আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক খান গোলাম কুদ্দুস বলেন, “আইকিউএসি সারা বছরই মান উন্নয়নের কাজে ব্যস্ত থাকে। ওরিয়েন্টশন ছাড়াও শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে যে তাদের আরো প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তাহলে তারা ডিসিপ্লিন কিংবা ছাত্র বিষয়ক পরিচালকের মাধ্যমে জানাতে পারে।”
অবকাঠামোগত সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, “এই মূহুর্তে আইকিউসির জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা ভবন তৈরির চিন্তাভাবনা নেই। আইকিউএসি কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে যে আলাদা একটা ভবন হলে ভালো হয় তাহলে ভবিষ্যতে অর্থ প্রাপ্তি স্বাপেক্ষে চিন্তা করা যেতে পারে।”
সম্প্রতি আইকিউএসি’র আয়োজনে গবেষণায় অনুদানপ্রাপ্ত প্রকল্পের আর্থিক ব্যবস্থাপনা শীর্ষক আয়োজনে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, ‘ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকতর উদ্ভাবন ও গবেষণায় অর্থমঞ্জুরী বৃদ্ধি করেছে। চলতি বছর এখাতে ১১৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।’ আগামী অর্থবছর তা ১৫০ কোটি টাকায় উন্নীত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।