চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ
সিটি অফ গড: অপরাধের শহরে বেড়ে ওঠার গল্প
পাভেল হোসেন | প্রকাশ: ২৩ মে ২০২২
চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ সিটি অফ গড: অপরাধের শহরে বেড়ে ওঠার গল্প পাভেল হোসেন | প্রকাশ: ২৩ মে ২০২২ সিটি অফ গড (পর্তুগীজ নাম- সিদাদ দি দিউস) ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ব্রাজিলিয়ান ক্রাইম-ড্রামা ঘরানার চলচ্চিত্র। রিও ডি জেনিরোর উপকণ্ঠের এক অনুন্নত বস্তি এবং এর অধিবাসীদের জীবনাচরণ, মাদক ও অপরাধ জগতের উপর ভিত্তি করে রচিত পাউলো লিন্স এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘সিদাদ দি দেউস’ অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচিত্রটি।
এর চিত্রনাট্য লিখেছেন ব্রাউলিও মানতোভানি এবং পরিচালনা করেছেন যৌথভাবে ফারনান্দো মেলেরিস এবং কাতিয়া লুন্ড। সেরা সিনেমাটোগ্রাফী, সেরা পরিচালকসহ মোট চারটি ক্যাটাগরিতে অস্কার মনোনীত চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর সমালোচক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত হয়।
চলচ্চিত্রটি এখন পর্যন্ত বহু আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছে। সেরা চিত্রনাট্য, সেরা চিত্রগ্রহণ, সেরা সম্পাদনা, সেরা পরিচালক; এই চারটি ক্যাটাগরিতে ২০০৪ সালে একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পায়। চলচ্চিত্রটি বিভিন্ন বিভাগে সর্বমোট ৭৪টি পুরস্কার জিতে নেয়। এছাড়া আরো অনেক বিভাগে মনোনীত হয়।
ট্যারেন্টিনোর ‘পাল্প ফিকশণ’ কিংবা সক্রেসোর ‘গূডফেলাস’ এর মত আত্মকথন ভঙ্গিতে আগানো চলচ্চিত্রটি ৬০-৭০ দশকের ব্রাজিলিয়ান অপরাধ জগতের একটি প্রতিচ্ছবি।
অতি শৈশবেই সেখানে একটি শিশু খুন এবং মাদকের অন্ধকার জালে জড়িয়ে যায়। কোন একজনের সাথে ঝগড়া কিংবা খেলার মাঠের তর্কাতর্কির প্রতিশোধ নিতেও তারা অপরাধীদের দলে যোগ দিয়ে রক্ত ঝরাতে দ্বিধাবোধ করে না।
যেখানে একজন স্বাভাবিক শিশু স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সেখানে সিদাদ দি দিউসের প্রতিটি শিশু স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে একজন গ্যাংস্টার হবার, অপরাধ জগতের শাহেনশাহ হবার।
পরিমিত উত্তেজনা, দুর্দান্ত সাসপেন্স, কঠোর বাস্তবতা আর খানিকটা রোমান্স মিলে সিনেমাটিকে করে তোলে আরও মনোমুগ্ধকর। বিশেষ করে এই চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফী অন্যতম সেরা কাজ।
আর ছবিটিকে আরো বাস্তবসম্মত করে তুলতে ছবিটির পরিচালক সিদাদ দি দেউস বস্তির বেশ কয়েকজন অধিবাসীদেরকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন। এমন সব অভিনেতাদের ব্যবহার করেছেন যাদের অধিকাংশই আগে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায়নি।
যার কারণে চলচ্চিত্রটি একই ধরনের অন্যান্য চলচ্চিত্র হতে বেশি বাস্তবিক অনুভূতি দেয়। তবে তাদের অভিনয় দেখে বোঝা যায় না যে এটা তাদের প্রথম কাজ। এতো সাবলীল অভিনয় খুব কম চলচ্চিত্রেই দেখা গেছে।
ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে কাহিনীর বেড়ে ওঠা। ঘটনা সিদাদ দি দেউস বস্তিতে। এখানে বসবাসরত সব মানুষগুলোই অসংলগ্ন ও অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করে। অপরাধের বেড়াজালে যাদের বেচে থাকার চেষ্টা।
আর সেখানের শিশুদের অবস্থা আরো শোচনীয়। প্রতিনিয়ত তারা নরকের দিকে যাচ্ছে। মাদক, খুন আর বিভিন্ন অপরাধে তারা নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে। এরকম বিরূপ পরিবেশে থাকার ফলে শিশুদের মানসিকতা ও তাদের অপরাধ প্রবনতা এবং তার ফলাফল নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। এটি খুব সহজেই প্রশংসার দাবীদার।
চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র রকেট নামক এক কিশোর। রকেট সে সময় শহরে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা গল্প আকারে একান্ত নিজের ভাষায় প্রকাশ করে। তার ভাইয়ের করুণ পরিনতি, তার স্বাধীন এবং পরিষ্কার জীবনের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, লিটল ডিজ এর লিটল ডিজ হওয়া, তার উত্থান-পতন, জীবনে আসা প্রেম-দুঃখ এবং তাকে ও তার শহরকে নিয়ে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা এ চলচ্চিত্রটিতে তুলে ধরা হয়েছে। এই সব ঘটনার মধ্যে মুল চরিত্রের ফটোগ্রাফার হবার সপ্ন রুপকথার মত মনে হয়।
চলচ্চিত্রটিতে রকেট ফুটিয়ে তোলে আমাদের সমাজে থাকা সকল শিশু ও সকল কিশোরদের। যাদের সপ্ন হয়তো অধরাই রয়ে যায় লাখো বাধা বিপত্তির বেড়াজালে। লিল ডিজের চরিত্র তুলে ধরে আমাদের মধ্যে থাকা সে সকল লোকেদের যারা অন্যের উপর নির্ভর করে উঠে যায় সমাজের শীর্ষে। তারা দিন শেষে যাদের জন্য তার বড় হয়ে ওঠা তাদেরকেই ভুলে যায়।
যদিও এই চলচ্চিত্রটি করা হয়েছে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও এর ৭০’র দশকের কাহিনী নিয়ে। কিন্তু আজও আমাদের আসে পাশে দেখা যায় এরকম হাজারো ঘটনা। আমাদের সমাজেও বর্তমানে কিশোর অপরাধের প্রবনতা বাড়ছে। কিশোর গ্যাং কালচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। খুব আলোচিত কিছু ঘটনা ছাড়া বেশির ভাগ ঘটনায় সবার সামনে আসে না। সেই সব ঘটনা থেকেই বের হয় সিটি অফ গড এর মতো কালজয়ী চলচ্চিত্র। আমাদের মধ্যেই রয়েছে অনেক রকেট, অনেক লিটল ডিজ।
চলচ্চিত্রটির কাহিনী রকেট এর চোখে দেখালেও মুভিটিতে প্রায় সমান যায়গা নিয়ে ও গুরুত্ব নিয়ে রয়েছে লিটল ডিজ। তার সপ্ন সে ক্রিমিনাল হবে। আর এই দুই চরিত্রের অদ্ভুত সংমিশ্রনে প্রকাশিত হলো সিটি ওফ গড। মুভিটির শেষে এটা সত্যি ঘটনা অবলম্বনে বলা হলেও অনেকে এ ব্যাপারে দ্বিমত জানান। কিন্তু এই দ্বিমত ছাড়া এই চলচ্চিত্রটি অধিকাংশ চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে সর্বকালের অন্যতম সেরা গ্যাংস্টার, অপরাধ ঘরানার চলচ্চিত্র।