খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় 'র্যাগ ডে'
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়
আসিফ অনিক | প্রকাশ: ১৫ মে ২০২২
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর ধাপ যেমন শত আশা-প্রত্যাশা আর আবেগ দিয়ে শুরু হয়, শেষ বেলাতেও তত আবেগ আর ভালোবাসা বেড়ে যায়। ভালোবাসার ১০৬ একরের কিছু তরুণ প্রাণ প্রতি বছর পূর্ণতা পেয়ে অশ্রুসজল চোখে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। হয়তো এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কারো কারো জীবনে হতাশারও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে সে সংখ্যা নিতান্তই কম। বরং জীবনযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই তারা এই প্রাণের ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায়। রেখে যায় হাজারো স্মৃতি। তবে জীবনের পরবর্তী পযার্য়ে সাফল্য হাতছানি দিয়ে ডাকলেও তাদের একটি শব্দ অনেক কষ্টেই উচ্চারণ করতে হয়, মেনে নিতে হয় ‘বিদায়’।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে এই ধারণাটির উৎপত্তি কবে বা কোথায়। মূলত ১৮২৮-১৮৪৫ সালের দিকে র্যাগ উইকের প্রচলন ঘটে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন ছাত্র সমিতি এর প্রচলন ঘটায়। আফ্রিকায় সর্বপ্রথম র্যাগ ডে পালিত হয় দক্ষিণ আফ্রিকার পিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২৫ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্নাতক শেষে এক বর্ণাঢ্য র্যালি বের করে।
ভালোবাসার মানুষ ছেড়ে চলে গেলে অথবা প্রেমে বিচ্ছেদ হলে তা প্রত্যেক মানুষের কাছে কষ্টকর। অথবা যেকোনো প্রিয় মানুষ বিদায় জানালে যেন মনে হয় সবকিছু হারিয়ে গেল। তখন প্রত্যেক মানুষের এমন মনের অবস্থা হয় তারা কিছুই প্রকাশ করতে পারে না তার প্রিয়জনের বিদায় নিয়ে।
এইতো সেদিন ক্যাম্পাসে পদার্পণের পরপরই শুনলাম ক্যাম্পাসে নাকি র্যাগ ডে। সিনিয়রদের থেকে ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে বুঝলাম র্যাগ মানে ক্যাম্পাসের ঈদ। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসেই সেই কাঙ্খিত র্যাগ ‘অদ্রিক ১৪’। ট্রাক র্যালী, কালার ফেস্ট এবং ব্যান্ড শিল্পী জলের গানের মাতামাতি। তবে সবটুকু ছাপিয়ে কনসার্ট শেষে তাদের সাথে শেষ মুহূর্তের দেখাটুকু যদি সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে পারতাম।
এভাবেই একইভাবে সেবছর ‘সংবর্ত ১৫’দের বিদায়ে শিরোনামহীন, এলআরবি : ‘সায়ন্তন ১৬’দের বিদায়ে অর্নব, আর্ক পুরো ক্যাম্পাসকে মাতিয়ে গেলেও শেষের সেই হৃদয়স্পশী মুহূর্তের কোনো পরিবর্তন দেখা যায় নি। বরং “পুরানো সেই দিনের কথা” গানের সাথে নিজেকে উৎসর্গ করে প্রত্যেক বিদায় পথের যাত্রী তাদের প্রিয়মুখগুলোকে অশ্রুসজল চোখে বিদায় দিয়েছেন। এবং কালের পরিক্রমায় ইতোমধ্যে ‘সত্যম ১৭’ ও বিদায় নিয়েছে।
ভর্তিযুদ্ধ পরীক্ষা শেষে একজন শিক্ষার্থী অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে ক্যাম্পাসে আসে। ক্যাম্পাসে এসেই সে প্রথম দিনেই অনেকগুলো অপরিচিত মুখ দেখতে পায় যাদের সাথে আগামী চার বছর তার পথ চলতে হবে। এছাড়াও নিজের বড় ভাই বা আপু সমতুল্য সিনিয়রদের সাথে পরিচয় যাদের হয়তো প্রথমে অনেকেই সহ্য করতে পারে না। তবে এই সিনিয়রদের তাগিদেই নিজের সহপাঠীদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি ও নানা টার্ম সম্পর্কে জানতে পারে। তাদের মাধ্যমেই হয়তো ক্যাম্পাসের নানা সংগঠন সম্পর্কে জানতে পারে এবং পরবর্তীতে সংগঠনগুলোর মাধ্যমে নিজেদের ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
বারো মাসে তেরো পার্বনের মতো ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একত্রে ঘোরাঘুরি করে, ভলিবল কিংবা ক্রিকেট টুর্নামেন্টে একত্রে ডিসিপ্লিনের নামে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেয়। এভাবে নিজের অজান্তেই অপরিচিত ব্যাচমেট, সিনিয়ররা আপন হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয় বর্ষে সদ্য সিনিয়র হওয়ার প্যারা, তার ওপর আবার ক্যাম্পাসের স্বরস্বতী পূজা, পিঠা উৎসব বা দিপাবলী নামানোর দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে। তৃতীয় বর্ষে গিয়ে আবার পহেলা বৈশাখের মতো বড় প্রোগ্রামসহ রাজ্যের দায়িত্ব নিতে হয়। এরপর চতুর্থ বর্ষে এসে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাবের মাঝেও নিজেদের সর্বশেষ প্রোগ্রাম র্যাগ নামাতে হয়। পুরো একটা ব্যাচের এতগুলো ছেলে-মেয়ের দুই মাসের রাতজাগা পরিশ্রমের ফল একটা বিদায় অনুষ্ঠান যা সকলকে অশ্রুসজল চোখে বিদায় দেয়।
চার বছরের ৯-৫টা ক্লাস, সিটি, অ্যাসাইমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, ভাইভা, ল্যাব, পিএল, পরীক্ষা, থিসিস, ডিফেন্স এর চাপের ফাঁকে কেউ কেউ হয়তো সকালের নাস্তার সুযোগে ক্যাফেটেরিয়ায় চা-পরোটার সাথে একটু আড্ডা নেয়, কেউ কেউ হয়তো দুপুরের ক্লাসের ফাঁকে সেন্ট্রাল মসজিদে নামাজটা পড়ে নেয়, বিকালে হয়তো তপনদা বা সাইদুল ভাইয়ের দোকানে কেউ একটু শিঙারা, চপ খেয়ে নেয়, কোনো প্রিয়তম তার প্রিয়তমাকে রাত ৮টার আগে অপরাজিতা বা বঙ্গমাতা হলে তড়িঘড়ি করেই এগিয়ে দিয়ে আর একটু সময়ের আক্ষেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
এরপর হলের ডাইনিং, ক্যান্টিন বা হল রোডে খাওয়া দাওয়া শেষে হয়তোবা তারা জীবন নিয়ে আলোচনা শুরু করে। দল ধরে ক্যাফেটেরিয়া, মুক্তমঞ্চ, শহীদ মিনার, অদম্য বাংলা, চারুকলা বা লেকের পাড়ে হয়তোবা গানের আড্ডা বসে যেখান থেকে গিটারের টুং টাং আওয়াজের সাথে কারো কারো ভাঙা গলা ভেসে আসে যার কোনো কোনোটি হয়তোবা সূর্যোদয়ের মাধ্যমে শেষ হয়। এভাবে এতোটা ব্যস্ততার মাঝে এই প্রাণগুলো জীবনের পূর্ণতার অপেক্ষায় উৎসুক হয়ে থাকে।
এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী পূজা সাহা বলেন, ক্যাম্পাসে এসে শুনেছি খুলনার সবচেয়ে বড় উৎসব খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ ডে। ‘র্যাগ ২২’ (সত্যম ১৭- এক সাথে এক সাত) পাওয়ার পর বুঝেছি খুবির র্যাগ ডে তে যে একবার থাকে, তার তো পরের র্যাগ ডে এর জন্য তর সইবে না। অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করবে।
সেই উৎসুক চোখগুলো এক সময় ধূসর হয়ে যায়। বিদায়ের ঘন্টা যে বেজে যায়। ডায়েরির পাতা জুড়ে জমে থাকে কতশত স্মৃতি! জীবন বহমান, সময়ের প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়াই জীবনের ধর্ম। তবু জীবনে চলার পথে এই মুখগুলোর সাথে যদি আবার দেখা হয় হয়তো এই চার বছরের স্মৃতির ডায়েরি খুলে বসবে।
ডায়েরির পাতার পর পাতা রোমন্থণ করবো তবু গল্প শেষ হবে না। চোখের সামনে ভেসে উঠবে এই চার বছরের হাসি, কান্না, রাগ অভিমানের স্মৃতিগুলো। এই আশাগুলোকে বুকে ধারণ করেই শেষ হয় ১০৬ একরের এই ক্যাম্পাসের একেকটি ব্যাচের পথচলা।