Sunday, December 22, 2024
Sunday, December 22, 2024

কেসিসির পরিছন্নতাকর্মী

তাদের খবর রাখে না কেউ

শামিমা নাসরিন | প্রকাশ: ২১ মে ২০২২

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের পরিছন্নতাকর্মী মহাবীর লাল দাস এবং পুট্টি। ছবি: শামিমা নাসরিন।

‘আমার হাতের তৈরি খাবার কে খাবে? আমিতো সেপটিক ট্যাংক, ল্যাট্রিন, ড্রেন পরিস্কার করি। নিজ উদ্যেগে খাবারের দোকান দিলেও আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষজন ছাড়া কেউ স্পর্শ করবে না কারন আমারা মেথর’ এভাবেই নিজের দুর্দশার কথা বর্ণনা করছিলেন খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) পরিছন্নতাকর্মী মহাবীর লাল দাস।

এটি শুধু মহাবীর লাল দাসের একার দুর্দশার কথা নয়, সোনাডাঙ্গা-ময়লাপোতা হরিজন কলোনিতে বসবাসরত ২০০ পরিবারের সামাজিক মর্যাদা ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার গল্প। সেপটিক ট্যাংক পরিছন্নতাকর্মীরা সবাই হরিজন সম্প্রদায়ের। যারা সবার কাছে মেথর নামে পরিচিত। তারা দলিত সম্প্রদায়ের নিন্মশ্রেণীর মানুষ বলে স্বীকৃত।

একসময়কার সেপটিক ট্যাংক পরিছন্নতাকর্মী পুট্টি এখন বাসাবাড়িতে দিনের বেলায় কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন। নিজের দুর্দশার কথা স্মরণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ডাক্তার দেখিয়ে ১০ টাকা খরচ করবো নাকি অসুস্থতা সহ্য করে টাকা বাঁচিয়ে রাখবো। আমরা যে টাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে বেতন পেতাম তাতে সংসার চালানো কঠিন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আশেপাশের অন্য ধর্মের মানুষজনও আমাদের ঘৃণার চোখে দেখে। কারন আমরা আপনাদেরই ফেলে দেওয়া ময়লা পরিস্কার করি। এসব কাজে আমরা অসুস্থ হলেও ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাই না। তাই বাধ্য হয়ে, ঘৃণার চোখ থেকে বাচার জন্য সিটি কর্পোরেশনের কাজ ছেড়ে দিয়েছি।’

এই কলোনিতে ২০০ পরিবারের মধ্যে একজন চাকরি করলেও ৩ জন বেকার। একই ঘরে ২টি পরিবার পর্যন্ত বাস করে। একই ঘরেই চলে তাদের রান্নাবান্না।

এর কারণ হিসাবে মহাবীর লাল দাস বলেন, ‘আমরা জাতিগতভাবে মানববর্জ্য পরিস্কার করে থাকলেও পরিছন্নতাকর্মী হিসাবে অগ্রাধিকারের দিক থেকে মুসলিমরা চাকরি পায়। সিটি কর্পোরেশন থেকে আমাদের পুর্নবাসনের জন্য অনেক বার উদ্যেগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোন কাজবাজ এগোতে দেখি না। সেই ২০১০ সালে বলা হয়েছিল আমাদের পূর্নবাসনের ব্যবস্থা হবে কিন্তু এখনও হয়নি। আমরা সব কিছু থেকে বঞ্চিত, সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা সবকিছুতেই আমরা পিছিয়ে।’

কেসিসির উপসহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘হরিজন কলোনিতে আমরা আপাতত ফুটপাত সংস্কার করেছি এবং তাদের বসবাসের স্থান কিছুটা উন্নত করেছি। তাদের আবাসনের পরিকল্পনা ও প্রকল্প এখনও চলমান। কারণ আমরা সম্পূর্ণ অর্থায়ন না পাওয়া জন্য এখনও বাস্তবায়ন করতে পারছি না।’

এ সম্প্রদায়ের গ্রাম কমিটির সভাপতিকে পুর্নবাসনের বিষয়ে করলে তিনি বলেন, ‘এই ভিটা আমাদের না, সিটি কর্পোরেশন থেকে বরাদ্দকৃত। তাই মাঝে মধ্যে কেসিসি থেকে নোটিশ আসে এই এলাকা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। এ কারণে আমরা আবাসস্থলের জন্য আন্দোলন করি, মানববন্ধন করি। আমাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য বিভিন্ন অফিসে দৌড়াদৌড়ি করি।’

পরিছন্নতাকর্মী কিশোর দাস বলেন, ‘এই সম্প্রদায়ের প্রধান সমস্যা হলো বেকারত্ব। কারণ হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য বরাদ্দকৃত চাকরিগুলো প্রায় অন্য সম্প্রদায়ের সদস্যদের দিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেপটিক ট্যাংক পরিস্কার করার যন্ত্র আসার পর থেকেই অনেকের জীবিকার পথ বন্ধ হয়েছে। কারণ এক মেশিনই ৫ জনের কাজ করে দেয়।’

এ সকল পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সিটি কর্পোরেশনে চাকরির অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়ে কেসিসির কঞ্জারভেন্সি অফিসার আনিসুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য এখনও কাজ করে যাচ্ছি। কিভাবে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেপটিক ট্যাংক পরিস্কার করা যায় সেই বিষয়ে তাদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের নিরাপত্তার জন্য আমরা ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহ করে থাকি। এছাড়া নিয়োগের ক্ষেএে সমান অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।’

কলোনির শিশুদের পড়াশুনার জন্য নির্মিত সোনাডাঙ্গা দলিত স্কুল। ছবি: শামিমা নাসরিন।

কলোনিতে শিশুদের পড়াশোনার জন্য দলিত সংস্থা থেকে গড়ে দেওয়া ছোট একটি স্কুল রয়েছে। সেখানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে বাচ্চাদের পড়াশোনার চাহিদা থাকলেও পরিবারের অর্থ সংকটের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে।

স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে গেলে কর্মরত শিক্ষক শফিক জানান, ‘করোনার জন্য অর্থায়নের অভাবে কাজ করা হয়নি। কিছুদিন আগে স্কুলের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তালিকা করে নিয়ে গিয়েছে।’

স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আসিফ বলেন, ‘আমরা চাইলেও ভালো স্কুল-কলেজে পড়তে পারি না। অর্থ অভাব তো আছেই। আর যখন আমাদের পরিচয় এবং আবাসস্থলের ঠিকানা বলি তখন তারা মানুষ হিসাবে প্রাপ্য সম্মানটুকুও দেয় না।’

নিজ ও সকল হরিজন সম্প্রদায়ের প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী উওম বলেন, ‘কেউ আমাদের নিজস্ব পরিচয় স্বীকার করে না, আামাদের অধিকারও দেয় না। আমরা আামাদের অধিকার চাই ভালো, পরিবেশে বাঁচতে চাই। আমরা ধনী হতে চাই না, শুধু আমাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই।’

আরও পড়ুন