Sunday, December 22, 2024
Sunday, December 22, 2024

‘জীবন আমাকে দিয়েছে কম নিয়েছে বেশি’

এস এম মেহেদী হাসান শাওণ | প্রকাশ: ১৯ মে ২০২২

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদম্য বাংলা ভাস্কর্যের সামনে মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা তার বন্ধুর সাথে। ছবি: মেহেদী হাসান শাওণ।

‘ভাই, জীবন আমাকে দিয়েছে কম নিয়েছে বেশি। তাও কই আর যাবো, আল্লাহর কাছেই সব চেষ্টা আর অভিমান’ জীবনের প্রতি প্রবল আক্ষেপের কথা এভাবেই বলছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা। খুললা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাদাম ও বুট বিক্রি করে জীবকা নির্বাহ করেন তিনি। 

দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয়ে মায় আর স্ত্রীর দেখাশোনা করেন। কিন্তু অন্ধ হওয়ার আগে তার অবস্থা এমন ছিলো না। ভ্যান রিক্সা চালিয়ে ভালোই আয় রোজগার করতেন। সেসময় ছোট তিন ভাইকে সাহায্য করেও মাস শেষে কিছু সঞ্চয় থেকে যেত। 

যেভাবে অন্ধত্ব বরণ করেন গোলাম মোস্তফা 

কিছুদিন ধরে চোখে দেখতে অসুবিধা হতো। বৈদুতিক বাতি বা সূর্যের মতো যেকোনো আলোর ঊৎসের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতেন না। চোখে ঘোলা দেখতেন। 

ঝামেলা এড়াতে চেয়েছিলেন বলে সাথে সাথেই কুদির বটতলা চক্ষু হাসপাতালে যান চিকিৎসার জন্য। সপ্তাহখানেকের ওষুধ নিয়ে ফিরে আসেন। তবে ওষুধে যেন কাজ করছিল না। যত দিন যায় চোখের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছিলো। ডাক্তাররাও কিছুটা হতাশ হয়ে তাকে ঢাকার ইস্পাহানী ইসলামিয়া ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসা জন্য পাঠিয়ে দেয়। 

সেখানেও প্রায় ৫ মাস ঘোরাঘুরির পর তাকে জানানো হয়, যদি সক্ষমতা থাকে তাহলে তিনি যেন দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যান। সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর একজন রিক্সা চালক গোলাম মোস্তফা তার সকল সঞ্চয় নিয়ে ইন্ডিয়া চলে যান চিকিৎসার জন্য। 

খান থেকে জানতে পারেন তার চোখে তেমন কোন সমস্যা ছিলো না। কিন্তু পূর্বের ডাক্তাররা রোগ নির্ণয়ে ভুল করেন। ভুল চিকিৎসার জন্য তার চোখের ভেতরের রেটিনা গুলো ছিঁড়ে গেছে এবং এখনো যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অন্ধ হয়ে যাবেন। 

কঠিন এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো সুযোগ ছিলোনা তার। তাই তিনি সব সঞ্চয় আর চোখের আলো শেষ করে দেশে ফিরে আসেন অন্ধত্বের কাছে। 

কিভাবে, কেমন যাচ্ছে মোস্তফার জীবন

না, বাস্তবতা তাকে অন্ধত্বের জন্য একপেশেভাবে কোন ছুটি দেয়নি। তাকে খুঁজে নিতে হয়েছে কর্ম। তখন তার একটা মেয়ে, মা আর স্ত্রীর সুন্দর সংসার। কেউ তার আর্থিক অনটন না বুঝলেও তার ছোট শিশু মেয়েটি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। তাই তো মাস খানেকের মাথায় অসুস্থতার অযুহাতে বাবার খরচ কমিয়ে দিয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়। চোখের মনি তো তিনি আগেই হারিয়েছেন, এবারে যেন নিজ কলিজার অর্ধেক হারিয়ে ফেললেন। 

বছর যেতে না যেতেই তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হয়ে ওঠেন। তবে পরম করুণাময়ের পরীক্ষা তখনো যেন শেষ হয়নি। ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই স্ত্রীর গর্ভে মারা যায় তাদের দ্বিতীয় সন্তানটি। স্ত্রীও তারপর থেকেই অসুস্থ। দৈনিক তার ৪০ টাকার ওষুধ খেতে হয়। মোস্তফার মায়েরও বয়স হয়েছে তার শরীরও ভালো যায় না। ছোট তিন ভাই থাকলেও ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক তারা ভুলে গেছেন। 

জীবন থেকে কি চান মোস্তফা এখন? 

গোলাম মোস্তফা নিজের জন্য ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন। তবে তিনি ভালভাবেই জানলেন, গরিবের ন্যায়বিচার মেলে না। তাই পরিবারের জন্য যতটুকু করা যায়, যেভাবে করা যায় এখন মোস্তফা তাই করছেন। 

সৃষ্টিকর্তার কাছে চিকিৎসার একটি ক্ষুদ্র আশা রাখলেও তিনি জানেন ৮ থেকে ১০ লক্ষ টাকা ব্যয়ের চিকিৎসা ইহকালে তার প্রাপ্য হবে না। তাই তিনি এখন একটা কর্ম চান। ভিক্ষা নাকি কোন বৃত্তি হতে পারে না। কর্ম করে দু পয়সা রোজগার করতে চান। দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা আয় হলেই তার আর কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না বলে মনে করেন তিনি। 

কিন্তু সমাজ অন্ধত্বকে করুনা করে কিছু ভিক্ষা দিলেও তার কর্মময় ব্যক্তিসত্তার আকাঙ্খা পূরণ করতে কি সমাজ-দেশ আদো সম্ভব হবে?

আরও পড়ুন