Sunday, December 22, 2024
Sunday, December 22, 2024

ক্ষতি পোষাতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম, উল্টো বেড়েছে বৈষম্য

শরিফুল ইসলাম | প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২১

শরিফুল ইসলাম

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মুনমুন খাতুন তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাস শুরু হলে নেটওয়ার্ক জনিত সমস্যার কারণে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারেনি। জুম প্লাটফর্মে ক্লাসে জয়েন দেওয়ার একটু পরেই শিক্ষকের লেকচারের কিছুই শুনতে পেত না। ক্লাস থেকে অটোমেটিক্যালি লিভ হয়ে যেতো।

অনলাইনে ভাইবা গুলো দিয়েছে বাসা থেকে এক কিলোমিটার দূরে যেয়ে। তবে নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকার জন্য বাসা থেকে এতদূরে যাওয়া সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ে অফলাইন-অনলাইন সম্বনিত পরীক্ষা তারিখ ঘোষণার সাথে সাথে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। পুরানো পড়া অতিদ্রুত শেষ করেই পরীক্ষায় বসতে হবে। ভালো নেটওয়ার্ক কানেকশন পাওয়ার জন্য বাসা থেকে খুলনা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।

মুনমুন খাতুনের মত অনেক শিক্ষার্থী এমন বৈষম্যের স্বীকার হয়েছেন। যেখানে তাদের অনান্য সহপাঠীরা ভালোভাবে ক্লাসে উপস্থিত থেকে শিক্ষকদের সাথে স্বশরীরে ক্লাস রুমের মত যোগাযোগ করতে পেরেছেন। কিন্তু যাদের নেটওয়ার্ক এর সমস্যা ভালো মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ নেই অথবা ইন্টারনেট কেনার পর্যাপ্ত সাম্যর্থ নেই তারা বৈষম্যের স্বীকার হয়েছেন এই অনলাইন শিক্ষা থেকে। যদিও স্বশরীরে সকল শিক্ষার্থীরা একই ক্লাস রুমে বসে পড়াশোনার সুযোগ ছিল, কোন ধরনের কারও ক্ষেত্রে অসুবিধা হত না।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারনে সারাদেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠাণ বন্ধ রয়েছে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে। সংক্রমণের গতিবিধি পর্যালোচনা করে শিক্ষা মন্ত্রাণালয় থেকে দফায় দফায় ছুটি বাড়ানো হয়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০ তম দিন অতিবাহিত হয়েছে। বন্ধের সময় গুলোতে শিক্ষার্থীরা যেন পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে না পড়ে সেজন্য অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষায় বসার জন্য একজন শিক্ষার্থীর এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ভালো নেটওয়ার্ক, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, ইত্যাদি দরকার। কিন্তু এধরনের সুবিধা সকল শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। এজন্য অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে বৈষম্য বেড়েছে। কোনো শিক্ষার্থীদের ভালো মোবাইল ফোন রয়েছে আবার তার ভালো নেটওয়ার্ক পায় না এক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থী ঠিকমত ক্লাসের লেকচার শুনতে পায় না। আবার যাদের ভালো মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ নেই, তাদের ক্লাসে জয়েন করার সুযোগ একেবারেই কম।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোস্তাক আহমেদ বলেন, করোনাকালীন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতিত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় বন্ধই আছে বলা যায়। অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া সকল শিক্ষার্থীকে শিক্ষা কার্যক্রমে সংযুক্ত রাখতে কতটুকু সফল সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। বিশেষ করে অস্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা অনেক শিক্ষার্থীই পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিভিন্ন কাজে যোগ দিচ্ছে। টেলিভিশন এবং অনলাইনের মাধ্যমে (অল্পকিছু স্কুল-কলেজে) নেওয়া ক্লাসেও আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। শেষ কথা হচ্ছে, শিক্ষা কার্যক্রম কার্যত বন্ধই আছে বলা যায় এবং অনলাইনে যেটুকু চালু আছে তাতে সবাই সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে না।আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নেটওয়ার্কজনিত সমস্যা ছাড়া বাকি সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে পরীক্ষাও নিচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জানান, অনলাইন পরীক্ষায় হঠাৎ করে এই নতুন সিস্টেমে সবাই ভালো করতে পারবেনা। যারা আগে থেকে দক্ষ তারা ভালো করবে অন্যরা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে পারে। এছাড়া যাদের একাধিক ফোন বা ল্যাপটপ আছে তারা নকল করতে পারে। অন্যদিকে আমাদের দেশের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েই অনেক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছে এদের এই অনলাইন সিস্টেমে পরীক্ষা দিতে বিরাট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। তার চেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যতো দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে সবার জন্য ভাল হয়। সব কিছু চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ থাকবে?

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইউসুফ মুন্না জানিয়েছেন কিভাবে করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে ও সমাধানের উপায় ও বলেছেন, আমার মনে হয় করোনাকালীন সময়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মাঝে বৈষম্য বাড়িয়েছে। নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত দুর্বলতা, প্রয়োজনীয় ডিভাইসের অভাব, আর্থিক অসমর্থতা সহ বিভিন্ন কারনে এই সমস্যা প্রকট হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে এই সমস্যা সর্বাধিক বিস্তৃত। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সরকারি-বেসরকারি নানান মহল থেকে বিভিন্ন উদ্যোগও নেয়া হয়েছিলো সময়ে-সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে ফোন অপারেটরদের যৌথ উদ্যোগে সুলভমুল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ কেনার ব্যবস্থা, ইউজিসি’র উদ্যোগে উপযোগী ডিভাইস কেনার ঋণ সহ বেশকিছু তৎপরতা চোখে পড়েছিলো। তবে সমন্বয়ের অভাবে এর কোনটা থেকে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি। তাই এমন সমস্যা থেকে উত্তরনের জন্য একদিকে যেমন সামনের দিনগুলোতে সমন্বয়ের দিকে মনোযোগী হতে হবে, অন্যদিকে দ্রুত টিকাদান কর্মসূচি সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন