কুঁড়েঘরের আদলে তৈরি খুবির ক্যাফেটেরিয়ায় স্মৃতিরা মেলে ডানা
মো. আল-আমিন | প্রকাশ: ১৭ মে ২০২২
আড্ডা, গান, পড়াশোনা- এক ক্যাফেটেরিয়াতেই সবকিছু! ক্যাফেটেরিয়া যে কেবল খাওয়া-দাওয়া কিংবা বিশ্রামের জায়গা নয় তার প্রমাণ মিলবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) ক্যাফেটেরিয়ায়। সদা প্রাণোচ্ছল খুবির এই ক্যাফেতে প্রতিনিয়ত তৈরি হয় হাজারো গল্প ও স্মৃতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদি চত্বরের পাশেই অবস্থান একতলা কুঁড়েঘরের আদলে তৈরি ছোট্ট এই ক্যাফেটেরিয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রতিষ্ঠান চলাকালীন খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রামের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় ১৯৯৫ সালে মুক্তমঞ্চ, শহীদ মিনারের পূর্বদিকে, ড. সত্যেন্দ্রনাথ বসু একাডেমিক ভবনের দক্ষিণে মনোরম পরিবেশে নির্মাণ করা হয় এই ক্যাফেটেরিয়া ভবন।
বিশাল বৃক্ষরাজির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই ক্যাফের তিনদিকে রয়েছে তিনটি প্রবেশ ও বহির্গমন পথ। পশ্চিমের প্রবেশ পথের ডানপাশে নানা ধরণের গাছ-গাছালির নিচে আছে সুসজ্জিত চেয়ার টেবিল। ক্যাফের ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই চোখ পড়ে এর দেয়ালে আঁকা প্রাণবন্ত সব ছবির দিকে। কোনো দেয়ালে মেঘ উড়ছে তো কোনো দেয়ালে ছেলে-মেয়েদের আড্ডা দেয়ার নান্দনিক সব হাতে আঁকা ছবি। যা দেখলে মুগ্ধ হবেন যে কেউ।
ভেতরেই ছোট্ট অংশজুড়ে খাবারের দোকান। যেখানে গরম সিঙ্গারা, সমুচার মতো লোভণীয় সব খাবার সাজানো থাকে সবসময়। দক্ষিণ দিকে পা বাড়ালে দেখা মিলবে ছোট্ট এক উঠোনের, যার চারদিকে ইট-পাথরের তৈরি বসার জায়গা।
মাথায় ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাব ও মেহগনি গাছ। এর থেকে একটু দূরে চোখ সরালেই নজরে আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ পানির লেকের উপরে। লেকের সৌন্দর্য বিমোহিত করে সকলকে। আর পেছনের অর্থাৎ পূর্ব দিকের পথ সংরক্ষিত আছে শিক্ষকদের জন্য। সেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে চেয়ার টেবিল দিয়ে সাজানো রয়েছে শিক্ষকদের অবসরের স্থান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারি সবাই অবসর সময়ে ভিড় করেন এই ক্যাফেতে। কেউ সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে এক-কাপ চা নিয়ে বসে পড়েন গাছের ছায়ায়। কেউবা সেরে নেন সকালের নাস্তা কিংবা দুপুরের খাবার। সারাদিনের পড়াশোনার ব্যস্ততা ভূলতে অনেকে মেতে ওঠেন গানে। তাদের গিটারের সূর ভূলিয়ে দেয় সব বিষণ্নতা ও ক্লান্তি।
কেউবা আবার দল বেঁধ মেতে ওঠেন সমসায়িক তর্ক-বিতর্কে। কোনো কোনো দিন শেষ বিকেলে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান সংগঠনের সদস্যদের একত্রিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শের দৃশ্য। মাঝে মাঝে নবীন-বরণ কিংবা বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় এই ক্যাফেতেই। তখন ক্যাফেটেরিয়া সেজে ওঠে অপরূপ সাজে।
লাল-নীল মরিচবাতি ও রঙিন সামিয়ানায় ক্যাফেকে মনে হয় উৎসবের রাজ্য। এছাড়া প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপনী অনুষ্ঠানের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় এই ক্যাফেটেরিয়ার একটা নির্দিষ্ট অংশকে কেন্দ্র করে, যার নাম দেয়া হয় ‘র্যাগ কর্নার’। এই র্যাগ কর্নারকে ঘিরে চলে গান-বাজনাসহ নানা আয়োজন। তবে পরীক্ষার মৌসুমে ক্যাফেতে দেখা যায় অন্য চিত্র। সবার হাতে বই-খাতা কিংবা নোট। চা-নাস্তা সারতে সারতে চলে শেষ প্রস্তুতি।
ক্যাফে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা, আবেগ কাজ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই এর সৌন্দর্য ও নিত্যনতুন আনন্দ উৎসব যেন তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত টান সৃষ্টি করে ক্যাফের প্রতি।
এমনই এক শিক্ষার্থী মোহতাসিম মাহিম বলেন, “ক্যাফেটেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দর জায়গার একটি, এখানে বসলে পড়াশোনার চাপ বা অন্যান্য সকল ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, প্রয়োজনে কোন বিষয়ে পরামর্শ করা, সব এখানে গাছের ছায়ায় বসে সেরে ফেলি।”
শুধু প্রথমবর্ষেই না, চার বছরে এই ক্যাফেকে ঘিরে প্রতিটি শিক্ষার্থীর তৈরি হয় অজস্র সব স্মৃতি, যা ভুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ১০৬ একরের ছোট্ট এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ এই ক্যাফেটেরিয়া। তাই একে ঘিরে আবেগের শেষ নেই।
শিক্ষার্থী প্রিন্স মৌলিক তাই আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, “বড় ক্যাম্পাসের ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে ছোট্ট এই ক্যাম্পাসের মধ্যে যা আছে তা ক্যাফে। গাদিগাদি করে বসা, চেয়ার খুঁজে না পাওয়া, হাতলওয়ালা চেয়ার নিয়ে মারামারি, এগুলো এই ক্যাফেতে পাওয়া যায়। এক মিনিটের জন্য বসে চারিপাশে একপলক তাকালেই সবাইকে চেনা যায়। ছোট্ট একটু ক্যাম্পাস তো! দেখলেই মায়া লাগে।”