Friday, May 3, 2024
Friday, May 3, 2024

বিশেষ সাক্ষাৎকার: সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম

কিছু অযোগ্য লোকের কারণে মফস্বল সাংবাদিকতা কলুষিত হচ্ছে

আফরিনী মমতা সিডনী | প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২১

Share on facebook
Share on email
Share on print
Share on twitter
Share on whatsapp
সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম

সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম, গোপালগঞ্জ প্রেসক্লাবের মহাসচিব ও ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি) এর গোপালগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা। তিনি সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তথ্য ও প্রযুক্তির এই যুগে সাংবাদিকতার হালচাল, বিভিন্ন বৈষম্যের দরুন উদ্ভূত ক্ষোভ, সাংবাদিক হিসেবে করণীয়, নানা চ্যালেঞ্জ, নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি, করোনাকালীন সাংবাদিকদের পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অদম্য বাংলা’র সাথে কথা বলেছেন। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আফরিনী মমতা সিডনী, শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। 

অদম্য বাংলা: প্রায়শই পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের উপর দলীয় রাজনীতির প্রভাব থাকার অভিযোগ আসে। এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি? 

সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম: এই প্রশ্নের জবাব খোলাখুলিই দেই কেমন! উত্তরটি হ্যাঁ! দলীয় রাজনীতির প্রভাবটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের উপর প্রায়শই থাকে! তবে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করবার সুযোগের বিষয়টাকেও আমি পুরোপুরি অস্বীকার করবো না। ক্ষমতাসীন দলের কারণে যেসব অনিয়ম হচ্ছে তা আমরা কিন্তু সবসময় প্রচার করতে পারছি না। হয় স্বেচ্ছায় কখনোও ক্ষমতাসীন দলকে ভালোবেসে অথবা নানাবিধ আতঙ্কে প্রকাশ করছি না। নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ টা খুবই কম। কারণ প্রশাসনই চলছে ক্ষমতাসীন দলের ইঙ্গিতে। এখানে কিছু রয়েছে সরাসরি নির্দেশনা যে এই ধরনের নিউজ প্রচার করা যাবেনা আবার কিছু রয়েছে অলিখিত নির্দেশনা। তবুও প্রায়শই এসব বাধাবিঘ্ন পার করে আমরা নিউজ তৈরি করে থাকি জনসাধারণের জন্যে। 

অদম্য বাংলা: সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ পাবার পর কি কি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন আর কতখানি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন বলে মনে করেন? 

সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম: একদম অকপটে বলছি আমি সাংবাদিকতাকে কখনোই পেশা হিসাবে নেই নি। দৈনিক জনতায় যোগদান করার পরে আমার শুরুতে নিয়োগ প্রাপ্তিটাই যথেষ্ট মনে হলেও পরবর্তীতে বেতন ভাতার প্রয়োজনীয়তা টের পেতে শুরু করি। কেননা আমার আয়ের বা চলার কোনো বিকল্প উৎস ছিলো না। পরবর্তীতে একজন বিখ্যাত সম্পাদকের সঙ্গে কথা হলে তিনি আমাকে জানান যে জেলা প্রতিনিধি হিসেবে বেতন ভাতার চিন্তা বাদ দিয়ে আমার বরং পত্রিকার কল্যাণে কিছু আর্থিক অবদান রাখা উচিত। তখনই আমার উপলব্ধি হলো যে আসলে আমার এই পেশায় সামনে এগিয়ে নিজের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সাংবাদিকতা নিয়ে ভবিষ্যত অনেক আশা থাকলেও পরবর্তীতে আমার এই পেশাকে শুধুমাত্র শখের পেশা হিসেবে নিয়ে অন্য আয়ের উৎস খুঁজতে বাধ্য হতে হয়। 

অদম্য বাংলা: কখনো হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন? সাংবাদিকতা জীবনের করা সেরা নিউজ সম্পর্কে বলুন। 

সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম: খুব সাদামাটা রিপোর্টার হিসেবেই পুরো সাংবাদিক জীবন অতিবাহিত করে আসলেও সম্ভবত ১৯৯১ সালের দিকে একটি নিউজ করেছিলাম। ঐ সময় গোপালগঞ্জ জেলায় হঠাৎ করে অ্যাম্পিসিলিন (অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসিউল) ঔষুধের খুব দূর্যোগ দেখা যায়। প্রথমত, অ্যান্টিবায়োটিক টি পাওয়া যাচ্ছিল না। দ্বিতীয়ত, অ্যান্টিবায়োটিকটির মধ্যে ভেজাল (আটা, ময়দা, বার্লি) মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছিল। শুরুতে আমি অনেকগুলো ফার্মেসী থেকে অ্যাম্পিসিলিনের স্যাম্পল সংগ্রহ করলাম। নির্দিষ্ট কয়েকটি ফার্মেসী সম্পর্কে অভিযোগ থাকায় আমি ঐ নির্দিষ্ট দোকানসহ আরও কয়েকটি দোকান থেকে ঐ ক্যাপ্সিউলের স্যাম্পল সংগ্রহ করে দোকানের লেভেলসহ একজন গবেষকের কাছে পরীক্ষা করে দুটো স্যাম্পলে ভেজাল পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম। এরপর ‘অবৈধ অ্যাম্পিসিলিন ক্যাপসিউলে গোপালগঞ্জের বাজার সয়লাব’ সূচক শিরোনামে একটি নিউজ লিখে পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিলাম। ঐ নিউজ প্রকাশের পরপরই ডিএসবি এই বিষয়ে তৎপর হলো, এবং ঐ ফার্মেসীর মালিকের বিরুদ্ধে তৎক্ষনাৎ অ্যাকশন নিয়েছিল। এই নিউজটি আমার পুরো সাংবাদিক জীবনে করা সেরা নিউজ বলে আমি মনে করি। এই নিউজটি যাতে প্রকাশ না করি এই জন্য আমাকে নানা ধরনের হুমকি ও আর্থিক লোভ দেখানো হলেও আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে পিছপা হইনি। 

অদম্য বাংলা: জাতীয় গণমাধ্যমে কর্মরত সংবাদ কর্মীর তুলনায় একজন স্থানীয় সংবাদ কর্মীকে কতোটা বৈষম্যের শিকার হতে হয়? 

সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম: প্রথমত, রাজধানীর বাইরের তথাকথিত কোনো সাংবাদিক আসলে সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে আসেনি। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশিরভাগেরই নিম্নমানের হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়েই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় একজন সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পাশ করে আসা সাংবাদিককে। কেননা তাদের মতের মিল খুব কমই হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, আরেকটি শ্রেণী রয়েছে যারা স্থানীয় সাংবাদিকতা পেশায় আসে শুধুমাত্র সাংবাদিকতার পরিচয়পত্রের জন্য। তাদেরকে আমি আমার ভাষায় আইডিকার্ড সর্বস্ব সাংবাদিক বলি। অধিকাংশের ক্ষেত্রেই তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাপামাধ্যম সম্পাদক বা ইলেকট্রিক মিডিয়া ব্যবস্থাপক কেউই আমলে নিচ্ছে না। যার দরুন কিছু অযোগ্য লোকের কারণে মফস্বল এলাকার সাংবাদিকতা কলুষিত হচ্ছে। 

কেননা একজন পরিপূর্ণ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ বিদ্যমান। তার বিবেকবোধ তাকে ঘৃণ্যতম অপরাধ থেকে বিরত রাখে। কিন্তু একজন স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তি যে একটি অসচ্ছল জায়গা থেকে এসেছে, সে কিন্তু অর্থ আয়ের জন্য মরিয়া হয়ে যাবে। সাংবাদিকতার নীতিমালা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় সে তার নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের দিকেও তাকাবেনা। সে তার পরিচয়পত্রকেই সব মনে করে কেননা তার আর কোনো আয়ের উৎস নেই। না পত্রিকা না টেলিভিশন কোনো জায়গা থেকেই তার লিখিত কোনো বেতন নেই। আমাদের পেশার ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো, ধরুন ৫০ জন বিভিন্ন হাউজের মোটামুটি ধরনের সাংবাদিক আছে, তারমধ্যে সর্বোচ্চ বেতন পাবে ১০/১৫ জন। এরচেয়ে বেশি কেউই নামমাত্র বেতন-ভাতা পায়না। খুবই কঠিন বাস্তবতা এটি। যার দরুন বাকি রয়ে যাওয়া সাংবাদিকেরা অসদুপায় অবলম্বন করতে বাধ্য হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা দুর্নীতিগ্রস্ত ধনীব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করে থাকে। জাতীয় পত্রিকাগুলোর আয়ের প্রধান উৎস হল বিজ্ঞাপন যা লোকাল নিউজপেপারের ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। বাস্তবিকপক্ষে, জাতীয় পত্রিকার কর্মীদের সঙ্গে স্থানীয়দের কোনো প্রকার তুলনাও চলেনা। এটি আসলে একটি ক্ষোভের জায়গা। দোষী হিসেবে আমি কর্তৃপক্ষের অসচেতনতা এবং জাতীয় পত্রিকার কর্মীদের সাপেক্ষে স্থানীয়দের অতিমাত্রায় বৈষম্যতাকে মানি। 

অদম্য বাংলা: বর্তমান করোনা পরিস্থিতি সাংবাদিকদের জীবনযাত্রার উপর কতোটা বিরূপ প্রভাব ফেলছে? 

সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম: দীর্ঘদিন দেশ লকডাউন থাকায় আর্থিকভাবে বেশিরভাগ সাংবাদিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যেসব সাংবাদিকদের কোনো বেতন ভাতার ব্যবস্থা নেই তাদের ফিল্ডওয়ার্কে গিয়ে একেকটি অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করেই রোজগারের ব্যবস্থা করতে হতো। এই মহামারীতে রোজগারের এই ব্যবস্থাটি নেই। এছাড়া নিউজ করার ক্ষেত্রেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমার কর্মপ্রতিষ্ঠান নিউজ এজেন্সি, ওখানে আমাদের যারা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করে তাদের কিছু কাজ ম্যান্ডেটরি কাজ আছে। যেমন: স্থিরচিত্র বা ভিডিও ফুটেজ দরকার। এই স্থিরচিত্রটি তারা ঐ এলাকায় অবস্থানরত সোর্সের কাছ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় সংগ্রহ করতে যদিও পেরেছে কিন্তু নিউজ করার সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তের অভাবে নিউজটি এলাবোরেট করতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। 

অদম্য বাংলা: বিশ্বজুড়ে প্রিন্ট মিডিয়া বা ছাপা মাধ্যমের প্রচার যে হারে কমছে তাতে কি এটি ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে বলে আপনি মনে করেন? 

সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম: প্রচারসংখ্যা কমে যাওয়াটা বিশ্বজুড়েই ঘটছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ছাপা প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশে এখনো গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদ, ঘটনা বা যেকোনো বিষয়ের সত্যতা যাচাই করতে মানুষ আজও ছাপা পত্রিকার ওপরই নির্ভর করে। আমি বলছি না যে ইন্টারনেট–নির্ভর সংবাদ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নির্ভরযোগ্য নয়। কিন্তু আবেগের বশবর্তী হয়েই হোক বা বাস্তবতা যে হিসেবেই বলিনা কেন, প্রিন্ট মিডিয়া এত সহজে হারিয়ে যাবেনা। এর এখনো অনেকটা পথ চলার বাকি। কিন্তু ইন্টারনেট–নির্ভর সংবাদ প্রচারের জায়গাগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়লেও সেই হিসেবে এখনো অনলাইন প্লাটফর্মগুলোকে আমরা টেকসই আয়ের উৎস বানাতে পারিনি। প্রিন্ট মিডিয়া এখনো প্রচারমাধ্যমের আয়ের প্রধান উৎস। 

অদম্য বাংলা: করোনা মহামারীর শুরু থেকে ফ্রন্টলাইনে থেকে কাজ করা গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন হাউজ নানান অজুহাতে ছাঁটাই করছে। এই অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আপনি কি কোনো প্রতিবাদ জানিয়েছেন?

সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম: এই বিষয়ে আমার একটু ক্ষোভের জায়গা রয়েছে। সত্যি বলতে সাংবাদিকদের সেন্ট্রালি যেসব সিদ্ধান্তগুলো হয় আমি এইগুলোকে কখনও সমর্থন করি না। কারণ জাতীয় নিউজপেপারে কর্মরত সাংবাদিকেরা কখনোই আমাদের স্থানীয়দের কথা ভাবেনা। সরকারের ৯ম ওয়েজ বোর্ড কার্যকর না হলেও ওরা শুরু থেকেই ৮ম ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী বেতন ভাতা পেয়ে আসছে যেখানে আমরা কখনো কিছু পাই না। এত বৈষম্য দেখেও ওরা কোনোদিন আমাদের জন্য আন্দোলন করেনি। তাই ওদের প্রমোশন হোক না হোক বা চাকরি থাকুক না থাকুক আমাদের বিশেষ কিছু আসা-যাবার কথা না। অনেক সাংবাদিক হয়তো কমিউনিটি বেসিকের উপর ভিক্তি করে ওদের পক্ষে নানা আন্দোলন করে কিন্তু আমি কখনোই এর পক্ষে নই। 

অদম্য বাংলা: বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা সরকার থেকে কতখানি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে এবং সাংবাদিকতার কতটুকু সঠিক চর্চা হয় বলে মনে করেন? 

সৈয়দ মিরাজুল ইসলাম: আমার জানা মতে স্থানীয় সাংবাদিকেরা সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতাই পায় না। সরকার চাইলেই বিভিন্ন পলিসি বা ওয়েজ বোর্ড গঠন করে মিডিয়া কর্তৃপক্ষকে বলে তাদের অধীনে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু কোনো অজানা কারণে এই পদক্ষেপ এখনও গ্রহণ করা হয়নি। হয়ত নানান ধরনের ঘোষণা হচ্ছে বা গোপনীয় কোনো ফান্ড ও থাকতে পারে কিন্তু আমি এমন কিছু আদৌ শুনিনি। আর বাংলাদেশে সাংবাদিকতার চর্চা নিয়ে আমি সত্যিই সন্তুষ্ট। সামান্য কিছু ত্রুটি, বিচ্যুতি ও অনিয়ম বাদে যেভাবে একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাতে সুদূর ভবিষ্যতে অনেক ভালো কিছু অপেক্ষা করে আছে।

Share on facebook
Share on email
Share on print
Share on twitter
Share on whatsapp

আরও পড়ুন