Monday, December 23, 2024
Monday, December 23, 2024

ঐতিহ্যের তীর্থভূমি খান জাহান আলীর মাজার ঘিরে জনজীবন

সাদিয়া ইসলাম মুমু | প্রকাশ: ২০ মে ২০২২

খান জাহান আলী মাজারের সম্মুখভাগ। ছবি: সাদিয়া ইসলাম মুমু।

বাগেরহাট শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত খান জাহান আলী মাজার। জায়গাটির মূল নাম ঠাকুর দিঘি মৌজা। সব মিলিয়ে ৩৬০ বিঘা জায়গা জুড়ে রয়েছে এই মাজার। এই মাজারকে ঘিরে ঘুরছে কয়েক হাজার মানুষের জীবনের চাকা।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ অঞ্চল পূর্বে হিন্দু জমিদারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। পরবর্তীতে খান জাহান আলী এ অঞ্চল অধিগ্রহণ করেন। মানুষের সুবিধার্থে তিনি এ অঞ্চলে মসজিদ, হাটবাজার, দিঘি খননসহ অনেক অবকাঠামো নির্মাণ করেন। 

স্থানীয়দের জীবনযাত্রা অনেকটা এই মাজারকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মাজার ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। মাজারে ওঠার সময় রাস্তার দুপাশে রয়েছে বিভিন্ন রকম দোকানপাট। খাবার থেকে শুরু করে হরেক রকম জিনিসপত্রের দেখা মেলে এ দোকান গুলোতে। 

মাজারের প্রধান ফটকের সামনে শেখ আজিজের দোকান। পাথর, তসবিহ, আতরসহ ইত্যাদির ব্যবসা তার। তিনি বিশ থেকে পঁচিশ বছর ধরে ব্যবসা করছেন মাজারে। এখানেই তার বেড়ে ওঠা। অন্য সময়ে জমিজমার কাজ থাকলেও মূলত আয় এই দোকান থেকেই হয়। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, বৈশাখ ও চৈত্র মাসে আয় তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। 

সপ্তাহে দুদিন, মঙ্গলবার ও শুক্রবার মাজারে হাট বসে। আশেপাশের গ্রাম থেকে দোকানিরা তাদের পন্য নিয়ে আসেন হাটে। বড় হাট বিধায় দামও তূলনামূলক কম থাকে। শহর থেকেও ক্রেতারা আসেন কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। হাটবারে শহর থেকে আসা খান সালেহ আহমেদ এর সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘তূলনামূলক কম দাম আর টাটকা শাক-সবজির জন্য চেষ্টা করি হাট থেকে কেনাকাটা করার।’ 

পর্যটন মৌসুমগুলোতে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফরে নিয়ে আসা হয় ঐতিহাসিক এ স্থাপনা দেখাতে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, ঐ সময়ের এই স্থাপনা দেখতে ভিড় করেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এছাড়া প্রতিদিন আশেপাশের অঞ্চল থেকেও দর্শনার্থীরা আসেন। কেউ আসেন প্রাচীন শিল্পকর্ম দেখতে, কেউবা আসেন মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। মাজারের কাজ মূলত স্থানীয় খাদেমদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। 

মাজারের দেখাশোনা ও অন্যান্য কাজ তারাই দেখে থাকেন। মাজারের একজন খাদেম ফকির সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আগের আর এখনের মাজারের তফাৎ বলতে গেলে মানুষের পরিবর্তনশীল ধর্মীয় চিন্তাভাবনার কারণে মাজারের ভাবমূর্তি অনেক সময় ক্ষুন্ন হয়’। 

তিনি আরো জানান, ‘এখন অনেক দর্শনার্থী আসেন যারা মাজারের পবিত্রতা সম্মন্ধে জানেন না, এমতাবস্থায় দেখাশোনার করতে গেলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের।’ 

মাজার ঘিরে বছরে দুইটি বড় উৎসব হয়। একটি বাংলা মাসের ২৫ অগ্রহায়ণ, আরেকটি চৈত্র মাসে। চৈত্র মাসের মেলা স্থানীয়ভাবে একটি ‘দরগা মেলা’ নামে পরিচিত যা প্রায় ৫৫০-৫৬০ বছর ধরে চলে আসছে। হিন্দু জমিদারদের দ্বারা এ মেলার প্রচলন শুরু হলেও পরবর্তীতে খান জাহান আলীর অধীনে এর ধরন পালটে যায়। 

এ মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দোকানিরা আসেন। মিষ্টি থেকে শুরু করে বাচ্চাদের টমটম (খেলনা), মেয়েদের প্রসাধনীসহ সবই এ মেলায় পাওয়া যায়। বাঙ্গালী ঐতিহ্য অনুসারে মাটি ও বেতের তৈরি জিনিসের দেখাও মেলে এখানে। মাটির পুতুল আর হাড়ি-কড়াই থাকে বাচ্চাদের আকর্ষণের কেন্দ্রে। হাওয়াই মিঠাই, ছোট পাখি, আর আচারের দোকানের ও দেখা মেলে এখানে। 

বাংলা মাসের ২৫ অগ্রহায়ণ ওরস হয়। সেসময় দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন। তারা মাজার পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে আসেন। তাদের উপলক্ষ্য করে মাজারে রান্নার আয়োজন করা হয়। এসময় বেশি দোকান দেখা যায় না। তবে অনেক মানুষ আসেন মাজার জিয়ারত করতে। 

মাজারের সামগ্রিক বিষয় খাদেমদের হাতে থাকলেও বিশেষ দিনগুলোতে প্রশাসনের সহায়তায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। মাজার ঘিরে শত শত বছরের এই ঐতিহ্য এমন নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাক সেই প্রত্যাশা জানান সংশ্লিষ্ট সকলে।

আরও পড়ুন